
লালবাগ, মুর্শিদাবাদ, সোমবার, ৩০/০৬/২০২৫
প্রতিবেদন :- সৌরভ আম্বলী
বাংলার ঐতিহাসিক ভৌগোলিক মানচিত্রে যে কটি স্থান এক অনন্য গুরুত্ব বহন করে, তার মধ্যে অন্যতম মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি। নবাবি আমলের এই সুবিশাল প্রাসাদ শুধু দর্শনীয় স্থাপত্যই নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আবেগেরও এক অনন্য নিদর্শন। আর এই ইতিহাসের বুকেই লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় এবং ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান—ইমামবাড়ি। হাজারদুয়ারি প্রাসাদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত এই ইমামবাড়ি সারাবছর দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকে। তবে প্রতিবছর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র মাস মহরমে—বিশেষ করে আশুরার দিন—মাত্র একদিনের জন্য খুলে দেওয়া হয় এই দরজা। এদিন নবাব পরিবার ও স্থানীয় শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্যোগে কারবালার শহিদদের স্মরণে আয়োজিত হয় বিশেষ ‘মজলিস’, মিলাদ ও মাতমের অনুষ্ঠান।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহ বা তার পূর্বসূরিদের আমলে এই ইমামবাড়ির নির্মাণ হয়, মূলত শিয়া ইসলাম অনুসরণকারী নবাব পরিবারের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের জন্য। মহরমের সময় এই স্থানে ধর্মীয় শোকানুষ্ঠান পালনের জন্য বড় করে আয়োজন হত। ইমাম হুসেন ও তাঁর পরিবার-সহ সাথীদের কারবালার প্রান্তরে আত্মবলিদানকে কেন্দ্র করে পালিত হত শোকদিবস। আজও সেই রীতির ধারাবাহিকতায় শুধুমাত্র মহরমের দিনেই নবাব পরিবারের উত্তরসূরিদের তত্ত্বাবধানে এই দরজা খোলা হয়, স্থানীয় মানুষজনের উপস্থিতিতে পালিত হয় ঐতিহ্যবাহী মজলিস। কিন্তু কেন সারাবছর এই ঐতিহাসিক ইমামবাড়ি বন্ধ থাকে? স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, এই স্থানে নবাব পরিবার ও তাদের বংশধরদের ধর্মীয় আবেগ গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। এটি কেবল একটি পুরাতাত্ত্বিক স্মৃতিস্তম্ভ নয়, বরং একটি পবিত্র ধর্মীয় স্থান। নবাব পরিবারের উত্তরসূরিরা এখনো এই প্রথা অটুট রেখেছেন। ধর্মীয় মর্যাদা রক্ষার্থেই এটি জনসাধারণের জন্য সারাবছর বন্ধ রাখা হয়।
সাংস্কৃতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইমামবাড়ি শুধু এক ঐতিহাসিক স্থান নয়, বরং বাঙালি মুসলিমদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরও এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। হাজারদুয়ারির পর্যটন কেন্দ্রিক প্রাসাদঘেঁষা অংশ হিসেবে থাকলেও ইমামবাড়িকে পবিত্রতার কারণে আলাদা করে দেখা হয়। এখানকার মেঝেতে বিছানো হয় কালো কাপড়, রাখা থাকে তাজিয়া ও আলম, যেগুলোর উপস্থিতি ইতিহাস, ধর্ম এবং শোককে একসূত্রে গেঁথে রাখে। বর্তমানে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে কেন এই ঐতিহাসিক স্থানটি বছরের অন্য সময় পর্যটকদের জন্য খোলা রাখা যায় না? এ প্রসঙ্গে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (ASI)-এর এক আধিকারিক জানান, “ইমামবাড়ির ধর্মীয় গুরুত্ব এবং নবাবি ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে বর্তমানে আমরা এটি খোলা রাখার কোনও পরিকল্পনা করছি না। তবে ভবিষ্যতে নবাব পরিবার ও স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের মত নিয়ে সীমিতভাবে দর্শনার্থীদের প্রবেশের চিন্তা করা যেতে পারে।”
মুর্শিদাবাদের ইমামবাড়ি শুধু একদিনের নয়, বরং শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির এমন এক অধ্যায় যা আজও গোপনে বয়ে চলেছে আবেগ, ঐতিহ্য ও গভীর ধর্মীয় চেতনা। হাজারদুয়ারির হাজার দরজার মধ্যে এই একটি দরজা যেন আজও রয়ে গেছে এক অলিখিত নিঃশব্দে, ইতিহাসের গভীরতম স্তরে।