
কৃষ্ণনগর,নাদিয়া,২৭/৬/২০২৫
বাংলার লোককথা, রূপকথা ও রসিকতার জগতে যে নামটি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও হাসির সঙ্গে উচ্চারিত হয়—সে নাম গোপাল ভাঁড়। তিনি শুধুমাত্র এক জন রাজবিদূষক ছিলেন না, ছিলেন এক অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ, যিনি নিজের কৌতুকপূর্ণ কথার মাধ্যমে সত্যকে প্রকাশ করতেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন এবং রাজসভায় নিজের উপস্থিতিতে প্রাণসঞ্চার করতেন।
গোপাল ভাঁড় ছিলেন নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভার প্রধান বিদূষক। সাধারণভাবে যাকে “ভাঁড়” বলা হয়, কিন্তু গোপালের ক্ষেত্রে “ভাঁড়” মানে শুধু হাস্যরস নয়—বরং যুক্তি, ব্যঙ্গ, সাহস ও সমাজ সচেতনতা। তাঁর বুদ্ধিমত্তার এমনই খ্যাতি ছিল যে রাজারাও তাঁর কথায় হাসতেন এবং শিখতেন।
রাজসভায় যখন পণ্ডিতেরা নিজেদের জ্ঞান জাহির করতেন, মন্ত্রীরা কূটনৈতিক বুদ্ধি দিয়ে রাজাকে প্রভাবিত করতেন—ঠিক তখনই গোপাল তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত বুদ্ধি আর মজার ভঙ্গিমায় এমন কিছু বলতেন, যা সকলকে চমকে দিত। কখনও কোনো দাম্ভিক সাধুকে শিক্ষা দিয়েছেন, কখনও মিথ্যেবাদী পুরোহিতকে মুখোশ খুলে দিয়েছেন—সবটাই রসিকতার মোড়কে।
একবার এক লোভী ব্রাহ্মণ গোপালের কাছ থেকে চেয়েছিল স্বর্ণের হাঁড়ি ধার। গোপাল জেনে গিয়েছিলেন, হাঁড়ি আর ফেরত আসবে না। তিনি নিজের বুদ্ধি দিয়ে এমন এক নাটক করলেন যে সেই ব্রাহ্মণ লজ্জায় হাঁড়ি ফিরিয়ে দিয়ে সবার সামনে অপদস্থ হলেন। এই গল্প শুধু হাসায় না, শেখায়—লোভে যে লাজ হারায়, সে একদিন চূড়ান্ত শিক্ষা পায়।
আজও বাংলার প্রতিটি শিশুর শৈশব গোপালের গল্প শুনে কেটেছে। বিভিন্ন বই, নাটক, টিভি শো এবং ইউটিউব চ্যানেল তাঁকে নতুন রূপে উপস্থাপন করেছে। কিন্তু মূল কথা একই—সত্যকে বলার সাহস, অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ এবং হাসির মাধ্যমে চিন্তা জাগানো।
এই যুগে যেখানে সত্যকে বলা কঠিন, যেখানে কটাক্ষ আর বিদ্রুপ প্রায়শই আঘাত করে—সেখানে গোপালের মত বিদূষক শেখান কিভাবে বুদ্ধি দিয়ে, সম্মান রেখে, কিন্তু ঠাট্টার ছলেই অন্যায়ের জবাব দেওয়া যায়।
গোপাল ভাঁড় শুধুমাত্র ইতিহাসের এক চরিত্র নন—তিনি একজন চিরন্তন শিক্ষাগুরু, যিনি হাসির ভিতরেও রেখে গেছেন জীবনের গভীর দিক। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—বুদ্ধি, সততা, আর হাসিই মানুষের আসল শক্তি।